Friday, May 31, 2019

**খাদ্যশূন্য দেশ ও খাদ্যপূর্ণ দেশ**

কোন এক জায়গায় পাশাপাশি ছিল দুইটি দেশ। একটি দেশ হচ্ছে খাদ্যশূন্য দেশ, আরেকটি দেশ হচ্ছে খাদ্যপূর্ণ দেশ। খাদ্যশূন্য দেশের রাজা খুবই নরম মনের ছিলেন। কিন্তু তার রাজ্যে খুব কম খাবার ছিল। আর অন্য দেশের রাজা ছিল হিংসুটে আর দেমাগী। তবে তার রাজ্যে খাবার ছিল ভরপুর। কিন্তু ভরপুর খাবার ছিল বলতে সারা রাজ্যে অনেক ফসল-টসল এসব কিছু না। তাদের কাছে ছিল যাদুর সিন্দুক। সেই সিন্দুক প্রতিদিন ভোর ৪টা ২০ মিনিট ৪০ সেকেন্ডে খুলতে হতো। তাহলে সেখান থেকে যত খুশি খাবার বের করা যেত। একটা সরালে নিচের দিকে আরেকটার জন্ম হয়। রাজা এই কাজ দেন কয়েকজন মানুষকে। তাদের গ্রুপের নাম ফুড কালেক্টর টীম। তারা প্রত্যেকদিন ৪ টা বাজে ওখানে গিয়ে অপেক্ষা করে। এবং অনেক ট্রাক নিয়ে আসে ও তাতে খাদ্য ভর্তি করে নিয়ে যায়। এবং পুরো দেশে সাপ্লাই দেয়। কিন্তু রাজার ছিল এক অদ্ভুত আর হিংসুটে নিয়ম। রাজা নিয়ম করে দেয় যে, কেউ এ খাবার অন্য কোন দেশেই দিতে পারবে না। এমনকি তাদের কাছের আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িও যদি দেশের সীমানার বাইরে হয়, তাদেরকেও খাবার দেয়া যাবে না। দিলে হবে তিন বছরের কারাদণ্ড। আর একই ভুল দু'বার করলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। আর অন্যদিকে খাদ্যশূন্য দেশে খাবার বলতে কিছুই ছিল না। শুধুমাত্র ছিল একটি ছোট্ট তরমুজের ক্ষেত। পুরো দেশে ওটাই একমাত্র খাদ্যের উৎস। লোকে মনে করে, অনেকদিন আগে বুঝি কেউ একজন এসে এই ক্ষেতটা আবাদ করেছিল। আর তাই এখন তাদের খাবারের উৎস। মিষ্টি খেতে ইচ্ছে করলে লোকে তরমুজ খায়। ঝাল খেতে ইচ্ছে করলে তরমুজের ছোলার তরকারি খায়। আর টক খেতে ইচ্ছে করলে তরমুজের ছোলা দিয়ে আচার বানিয়ে খায়। আবার যদি পানীয় পান করতে ইচ্ছে করে, তরমুজের জুস খায়। এতেই ঐ রাজ্য সুখে আছে। কিন্তু খাদ্যপূর্ণ দেশ তাও সন্তুষ্ট নয়। তারা চায় আরো কিছু। তবে খাদ্যপূর্ণ দেশে সবরকমের খাবারই পাওয়া যায়, শুধুমাত্র ফল পাওয়া যায় না। একদিন খাদ্যপূর্ণ দেশের রাজা তার মন্ত্রীকে বললেন, "এত গরমে আর টেকাই যায় না। কিছু একটা পানীয় পান করতে ইচ্ছে করছে।" তখন মন্ত্রী বলল, "রাজামশাই! পানীয় তো অনেকই আছে। সেভেন-আপ, স্প্রাইট- আরো কত কী! সবই তো আমাদের সিন্দুক থেকে বের হয়।" তখন রাজা বলল, "না, ওসব একঘেয়ে হয়ে গেছে। আর ওসবে ভালোমত পুষ্টিও নেই। আমার চাই তরমুজের জুস। কত বছর তরমুজের জুস খাই না।" মন্ত্রী বলল, "তরমুজের জুস পাব কোথায়? দেখুন মহারাজ, তরমুজের জুস তো আর পাওয়া যাবে না। আপনার যখন পুষ্টিকর পানীয় খেতে ইচ্ছে করছে, তখন পানি খান। পানি তো আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী! পানির কত গুণ! পানি  ছাড়া কোন প্রাণীই বাঁচে না।" (মন্ত্রী আরো বকবক করতে থাকল।) রাজা বকবক শুনতে শুনতে গলা ফাটিয়ে একটা চিৎকার দিয়ে বলল, "চুপ কর তুমি! অসহ্যকর! খেতে চেয়েছি তরমুজের জুস, আর উনি পানির পুষ্টিগুণ শিখাতে আসছে। ঐ বেটা, চাকরি খোয়াতে চাস নাকি? আমি কি তোমার কাছে পানির পুষ্টিগুণ শুনতে চেয়েছি? পারলে তরমুজের জুস এনে খাওয়াও। আর কে বলেছে, তরমুজের জুস নেই? খাদ্যশূন্য দেশেই তো আছে! সেখান থেকে একটু আনলে কী সমস্যা?" তখন মন্ত্রী ঐ দেশে লোক পাঠালো। পাঠিয়ে ঐ রাজার কাছে বলল, "আমাদের মহারাজ তরমুজের জুস খেতে চেয়েছেন। তাই এখান থেকে কয়েকটা তরমুজ নিয়ে যেতে চাই।" রাজা বলল, "কোন সিদ্ধান্ত নিতে হলে আমি নেই না, প্রশ্নটা বরং আমার প্রজাদের কাছে জিজ্ঞেস কর। তারা রাজি হলে ধরে নেবে, আমি রাজি।" তখন ঐ রাজ্যের লোক রাজ্যের প্রজাদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, "তোমরা কি আমাদের দেশের রাজার জন্য কয়েকটা তরমুজ দিতে পার?" তখন ঐ দেশের প্রজারা বলল, "অবশ্যই! কিন্তু তার বদলে সামান্য কিছু আপনাদের দেশের খাবার দিলে খুশী হই।" তখন ঐ রাজ্যের লোক বলল, "কেন? কয়েকটা তরমুজও এমনি এমনি দিতে পার না? কেমন আচরণ তোমাদের? ভালোয় ভালোয় কয়েকটা তরমুজ দিয়ে দাও। নইলে আমাদের রাজা কি করে, দেখো।" তখন খাদ্যশূন্য দেশের প্রজারা একটি কন্টেইনারের ভিতর এক গ্লাস তরমুজের জুস বানিয়ে ভরে দিল। বলল, "আপনাদের রাজা শুধু জুস খেতে চেয়েছে, তরমুজ চায়নি। তাই এই জুসটুকু আপনাদের রাজার কাছে দিয়ে দিয়েন।" ঐ রাজ্যের লোক তো ছিল একটু হাবাগোবা। শুধুমাত্র অন্য জিনিস চাওয়ার ক্ষেত্রে কী বলতে হবে, এটা শিখে এসেছিল। বাকি কিচ্ছুই তো শিখে আসেনি। তাই ঐটুকুই নিয়ে রাজার কাছে চলে আসল। রাজা খেয়ে বলল, "অসাধারণ! অনেক সুস্বাদু। মন্ত্রী! আমার তৃষ্ঞা গিয়েছে, কিন্তু খিদে যায়নি। আর খিদে আমি মিষ্টি তরমুজ দিয়ে মিটাবো। জুসই এত মজা, কামড়ে খেতে না জানি কত মজা লাগবে! আর মন্ত্রী তুমি হাবাগোবা লোক ছাড়া আর কাউকে পেলে না? এক কন্টেইনারে হালকা কিছু জুস এনে আমার হাতে ধরিয়ে দিল। আজব! মন্ত্রী, এবার তুমি নিজে গিয়ে আমার জন্য তরমুজ আনবে।" তারপর মন্ত্রী গেল ঐ রাজ্যে। গিয়ে বলল, "আমাদের রাজা তরমুজ কামড়ে খেতে চেয়েছে। দাও তো কয়েকটা তরমুজ!" তখন ঐ দেশের লোকেরা বলল, "ঠিক আছে। কিন্তু সামান্য কিছু খাদ্যপূর্ণ দেশের খাবার দিলে খুশী হতাম।" মন্ত্রী একটা ধাবড়ানি দিয়ে বলল, "কিসের এত বিনিময়? উপহার স্বরূপ কিছু দিতে পার না বুঝি? ভালো চাইলে জলদি করে কয়টা তরমুজ দাও।" খাদ্যশূন্য দেশের লোকেরা আর কী বলবে? তিনটা তরমুজ দিয়ে দিল। তারপর রাজা তরমুজ খেয়ে বলল, "অসাধারণের চেয়েও অসাধারণ! আহ, কী মজা! এবার আমার দুপুরের খাবারের সময় হয়েছে। এবার আমি তরমুজের ছোলার তরকারি দিয়েই খেতে চাই। এবার তুমি আর তোমার ঐ হাবাগোবা লোককে নিয়ে যাও। এবারের ছোলা তো ভুলে ফেলে দিয়েছি। আর আমি অত অপেক্ষা করতে পারব না। ওদেরকে গিয়ে বল, কয়েকটা টাটকা তরমুজের ছোলা ধুয়ে-কুটে রান্না করে পাঠাও।" মন্ত্রী ও তার হাবাগোবা লোক রাজার কথা অনুযায়ী কাজ করল। খাদ্যশূন্য দেশের লোকেরা বলল, "আমরা দুপুরে খাওয়ার জন্য এই মাত্র টাটকা টাটকা তরমুজের ছোলা রান্না করলাম। সেখান থেকে পুরোটাই দিয়ে দিতে পারি। কিন্তু তার বদলে যদি আপনাদের দেশের কিছু ভিন্ন ধরনের ভাত-তরকারি পাঠাতেন, তো ভালো হতো।" মন্ত্রী বলল, "কয়বার বলব, কোন বিনিময় নেই? কথা বাড়িও না! যদি করে মহারাজের জন্য কিছু তরমুজের তরকারি পাঠিয়ে দাও। আগের মত খাদ্যশূন্য দেশ আবারো তরকারি পাঠিয়ে দিল। রাজা খেয়ে বলল, "আজকে তো আমার খাবারগুলো দারুন হচ্ছে! এত ভালো তরকারি আমি আগে কোনদিন খাইনি। একটু পরেই তো বিকাল হয়ে যাবে। তোমরা তো জানই, আমার বিকালে হালকা-পাতলা কিছু চাটনি-আচার খেতে ভালো লাগে। আর আজকে আমি তরমুজের চাটনি-আচারই খেতে চাই। কারণ, এখন তো তরমুজই হয়ে গেছে আমার প্রিয় ফল। তোমরা দু'জন আবার যাও এবং আচার নিয়ে এসো।" আগের মতনই ঐ দেশের লোকেরা প্রথমে কিছু খাবার চাইল, তারপর আবার ঠিকমতোই বিনিময় ছাড়া রাজার জন্য আচার পাঠিয়ে দিল। রাজা চেটে চেটে আচার খেতে লাগল। আর বলল, "অসাধারণ! তরমুজই একটা অসাধারণ ফল। যাই একমাত্র আমাদের সিন্দুকে পাওয়া যায় না। এবার আমি ঘুমোতে গেলাম।" এরপর রাজা মন্ত্রীকে আবার বলল, "ইস! এ তরমুজ যদি রোজ রোজ পাওয়া যেত! মন্ত্রী, তুমি আমাকে প্রত্যেকদিন এরকম তরমুজ এনে দেবে, বুঝতে পেরেছ?" মন্ত্রী বলল, "কিন্তু ওরা তো প্রতিদিন বিনে পয়সায় দেবে না। আর এভাবে আনলে আপনার সম্মান যাবে কোথায়?" রাজা বলল, "খুবই চিন্তার বিষয়। দেখি, কিছু পাই কিনা ভেবে। এই, একটা বুদ্ধি তো মাথায় এসেছে। ওদের কাছে বাগানটাই কিনে নেই! থুক্কু, থুক্কু। কিনে নেই না, ভয় দেখিয়ে দখল করে নেই।" তখন মন্ত্রী বলল, "মহারাজ! আপনি যাই বলুন না কেন, এ কাজ আমি একা করতে পারব না। আমি ভয় দেখাতে পারলেও অতটা পারব না। আর আমার হাবাগোবা লোককে নেয়া আর না নেয়া তো সমান। রাজামশাই, আপনিই চলুন আমার সাথে। আপনার এত ইচ্ছে, নিজের হাতে নিয়ে আসলে আরো ভালো হবে।" রাজা বলল, "ঠিকই বলেছ! চল, এক্ষণি যাই।" এরপর রাজা ও মন্ত্রী দু'জন মিলে গেল খাদ্যশূন্য রাজ্যে। গিয়ে ঐ রাজ্যের প্রজাদের বলল, "তোমাদের বাগান তো আসলে আমাদের দেশের সীমানার মধ্যে পড়ে। আমি খুবই বিনয়ী মানুষ, তাই কিচ্ছু বলি না। আর এর আশপাশ দিয়ে যে তোমরা বাড়ি বানিয়ে থাক, তাও কিচ্ছু বলি না। এখন এ বাগানটা আমি পুরোপুরি আমার হিসেবে নিয়ে নিতে চাই।" খাদ্যশূন্য রাজ্যের প্রজারা এটা শুনে থ হয়ে গেল। তারা বুঝতে পারল না, রাজা এসব কী বলছে! শেষ পর্যন্ত তারা একটুখানি বুদ্ধি করে বলল, "হে আমার বিনয়ী মহারাজ! আপনি তো খুবই বিনয়ী। আপনি দয়া করে এই তরমুজের বাগানটা পুরোপুরি আপনার করে নেবেন না। আর যদি আপনি নেনও, তাও আমাদেরকে প্রতিদিন আপনাদের দেশের কিছুটা খাবার দেবেন।" রাজা তখন একটু রেগে গিয়েছিল। বলল, "ঠিকই বলেছ। আমি খুবই ভালো মানুষ। তাই আমি অসৎ জিনিস নিজের চোখে দেখতে পারি না। তোমাদের এই আবদার খুবই অসৎ আবদার। তাই আমি এ বাগানটি পুরোপুরি আমার করে নিলাম।" এই বলে রাজা ঐ দেশের কেউ কিছু বলার আগেই বাগানটি নিজের নামে করে নিল। তারপর মহা আনন্দে নিজ দেশের প্রাসাদে ফিরল।
কিন্তু আসলে ঐ বাগানটিতে অনেক ঝামেলা। সেই বাগানে চাষ করতে হয় অনেক বিশিষ্ট একটা পদ্ধতিতে। আর সেই পদ্ধতি ঐ খাদ্যশূন্য দেশের মানুষ ছাড়া আর কোন মানুষই জানে না। এদিকে বাগান দখল করে ফেলার পরের দিন থেকে রাজার ঐ সিন্দুকটাও খাদ্য দেয়া বন্ধ করে দেয়। কিন্তু তখন রাজা ওদিকে কোন খেয়ালই করলো না। সে তার প্রিয় ফল তরমুজ নিয়েই মহাখুশী। কিন্তু ওখানে যতটুকু তরমুজ ছিল, তা শুধু এক সপ্তাহেই খাওয়া যায়। ৬ষ্ঠ দিনে রাজা তরমুজ খেতে একটু অধৈর্য্য হলো। আর মনে মনে বলল, "আজকে সিন্দুকের খাবারই খাব।" কিন্তু সিন্দুক যে খাবার দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে, আর তার রাজ্যও যে খাদ্যশূন্য দেশের খাতা নাম লিখিয়ে বসে আছে, সেদিকে রাজার খেয়ালই ছিল না। এখন রাজা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। কিন্তু রাজা মনে মনে ভাবল, "যাই হোক, তরমুজ দিয়ে তো আরো অনেক দিন চালানো যাবে।" কিন্তু রাজার ধারণা ভুল ছিল। ৭ম দিনে শুধু একটা তরমুজ বেঁচে ছিল। রাজা তাও পাত্তা দেয়নি। কারণ, সে ভেবেছে, আরো তো চাষ করে নেয়াই যাবে। এত ভয় পাওয়ার কী আছে?" এই  বলে রাজা ঐ একটা তরমুজও সাবাড় করে ফেলল। আর রাজ্যের অন্য প্রজাদের কথা কিছু ভাবলও না। কিন্তু তারপর চাষ করতে গিয়ে দেখা গেল, কোনভাবেই ঠিকমত করে চাষ করা যাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত রাজাকে মাঠে মারা গিয়ে পস্তাতে হলো। আর ওদিকে খাদ্যশূন্য দেশের প্রজারা অন্য জমির সন্ধান পেল, যেখানে ধান সহ যাবতীয় গাছ ও সবজি ফলানো যায়। এরপর থেকে ধাদ্যশূন্য দেশ হয়ে গেল খাদ্যপূর্ণ দেশ, আর খাদ্যপূর্ণ দেশ হয়ে গেল একেবারেই খাদ্যশূন্য দেশ।

শিক্ষা: অতি লোভে তাঁতি নষ্ট।