Thursday, August 18, 2016

রূপার বায়না

এক ছিল এক কন্যা। সে খুবই ছোট। মনে কর পাঁচ-ছয় বছর হতে পারে। সব মা-বাবারাই পাঁচ-ছয় বছর বয়সী বাচ্চাদের সব কথা শোনে, যা চায় তাই দেয়। এই মেয়েটির নাম রূপা। ভালো নাম হলো রুপোঝিলমিল। তার মা তাকে রূপা বলেই ডাকত। শুধু তার বাবা রূপো বলে ডাকত, তাও পুরো ভালো নাম বলত না। তার মা-বাবারা তার কথা প্রায়ই শোনে। কিন্তু একদিন তার মা-বাবা বিরক্ত হয়ে তার কোন কথা শুনছিল না। এক সপ্তাহ ধরে যা চায় তা-ই দিতে হলো। এইজন্য এক সপ্তাহ পর মা-বাবা ক্লান্ত হয়ে গেল, তাই রাগ হয়ে গেল। রবিবারে মেয়েটি চেয়েছিল, পাঁচটি লজেন্স। সোমবারে চেয়েছিল দুই সেট চুরি। মঙ্গলবারে চেয়েছিল কানের দুল আর লাল গলার মালা। বুধবারে চেয়েছিল সুন্দর পুতুল। বৃহস্পতিবার চেয়েছিল পায়ের নুপুর। শুক্রবার চেয়েছিল মাথার ক্লিপ আর আংটি। শনিবার চেয়েছিল লাল গোলাপী ফুটফুটে সুন্দর ব্যাগ। তাই তার মা-বাবার অনেক টাকা খরচ হয়ে গেল। প্রায় তিন হাজার খরচ হয়েছে। শুধু তাই নয়, শুক্রবার তো ছুটির দিন। তাই সে তার মা-বাবার কাছে মেকআপ বক্স, কাজল, লিপস্টিক, মাথার ব্যান্ড, পায়ের আলতা, হাতে নেলপালিশ- এ ধরনের নানা রকমের সাজার জিনিস চেয়েছিল। আরেকটি ফ্যাশন টুপি। এতকিছু যদি কিনতে হয়, তাহলে দুই হাজার টাকা তো খরচ হবেই, তাই না? এমনকি সবচেয়ে ভালো সোনার চুরি দিয়েছে। পাঁচ-ছয় বছরের মানুষ সোনার চুরি পরে? তারপর মা-বাবা তো রেগে শুয়ে পড়ল। তখন রূপা মাকে বলল, "মা, আজকে আমার একটা ফুল আর প্রজাপতি ডিজাইনের জামা লাগবে। আর আরেকটা গোলাপী ডিজাইনের খাতাও লাগবে।" মা তো আরো রেগে গেল। উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। আর বকাবকি শুরু করল এই বলে, "এমন মেয়ে আমি জীবনেও দেখিনি। তুমি আমার কাছে এত জিনিস চাচ্ছ কেন? তুমি আমার জন্য কিছু কিনেছ যে, আমি তোমার দশ হাজার জিনিস কিনে দেব? আর চাই না আমি তোমার গিফট। এখন তুমি আমার কাছে কিচ্ছু চাইবে না, সরে যাও তাড়াতাড়ি। কত কিছু কিনেছ, টাকার হিসাব তো তুমি একদম বোঝই না। তুমি শুধু জিনিসের দাম বোঝ। শুধু বোঝ, দুই একটা পয়সা দেয়, আর একটা জিনিস নিয়ে নেয়। তাড়াতাড়ি চলে যাও।" তখন রূপা বাবার কাছে গেল। বাবাকে বলল, "বাবা, মাকে গিয়ে একটু মার না। মা আমাকে বকা দিয়েছে। আর আমাকে একটা ফুল আর প্রজাপতি ডিজাইনের জামা কিনে দেবে? মা আমাকে দেয়নি। মা আমাকে গোলাপী ডিজাইনের খাতাও দেয়নি।" বাবা বকল না। কারণ, বাবা একটু আহলাদু। তাই বলল, "আরে রূপো, শোন না, একটু এসব বাদ দাও না, মা। পড়ালেখায় মন দাও। এত জিনিস কিনতে পারব না। আর খাতা তো তুমি ছবি আঁকার জন্য কিনবে, পড়ালেখার জন্য তো না। আর মাকে এত মারা, বকা, এসব একটু বাদ দাও না। আর মা তো ঠিকই বলেছে। তুমি সারা সপ্তাহ ধরে কত কিছু কিনেছ। আজকে তোমার খাতা আর জামাও লাগবে? এত কিছু কি কিনে দেয়া যায়, মা? আমাদের টাকা তো সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। ও রূপোমনি, আজ অন্তত আমাদের একটু শান্তিতে থাকতে দাও না! আর রূপো, তুমি কবে একটু থামবে, বল না। আজ অন্তত একটু থাম। এই একদিন টুকু থাম। আর আমি কালকে রাতে যা বলেছি, তা তোমার মনে আছে?" রূপা বলল, "হ্যাঁ, মনে আছে। তুমি যদি মাকে না বক, আর জামা ও খাতা না কিনে দাও, তাহলে কিন্তু আমি তোমার রাতের কথা একদম শুনব না। তুমি তো বলেছ, যে আজ বিকেলে তোমার অফিসে ডিউটি আছে। বাচ্চাদের ঢুকানো, সিট গোনা, আর বাচ্চাদের সিট চিনিয়ে দেয়া, আর বাচ্চাদেরকে পরীক্ষার খাতা দেয়া। তুমি বলেছ আমাকে সিট গুনতে, আর বাচ্চাদেরকে সিট চিনিয়ে দিতে। আমি ওসব করতে পারব না, যদি তুমি আমাকে ওগুলো কিনে না দাও।" বাবা মহাজ্বালায় পড়ে গেল। বলল, "থাক না, মা। তুমি আজ অন্তত একটু থাম। আমি তো অনেকবার বলেছি এ কথা। আজ একটু সাহায্য কর আমাকে। আমি তোমাকে কত কিছু কিনে দিয়েছি। আর তুমি এটুকু করতে পারবে না?" তখন বাবা জ্বালার চোটে মাকে গিয়ে বলল, "এই, তুমি কি আমার রূপোমনিকে বকেছ?" "হ্যাঁ, বকেছি। তো কী হয়েছে? বকলে কি ও রাগে থড়থড় করে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেবে? কী এমন হবে একটুখানি বকলে?" বাবা বলল, "একটুখানি বকলে কিছু হবে নাকি মানে? তো আমার রূপোমনি যে বলল, "মা আমাকে বেশি বকে, সেই কথা কি তুমি বোঝ না, নাকি?" "হ্যাঁ, বুঝি। অবশ্যই বুঝি। এখন ঝগড়া না করে চলে যাও তো।" "কী, ঝগড়া আমি করেছি? না তুমি করেছ? তুমি রূপোকে বকেছ, তাই তো এ ঝগড়াটা হলো।" "আমি সাধে বকেছি? সারাটা সপ্তাহ একটার পর একটা জিনিস চেয়েই যাচ্ছে, আর আমি ওকে বকব না? আর আজ দেখ, আজও চেয়েছে, জামা চেয়েছে, খাতা চেয়েছে, পরে আবার কত কী চাবে?" বাবা বলল, "তুমি sure যে, পরে ও আবার চাইবে?" "হ্যাঁ, আমি sure, খুব আমি sure, কারণ ও এতদিন একটার পর একটা জিনিস চেয়েছে, আবারও চাইবে, এটাই আমার বিশ্বাস। তোমার রাগ হয় না, বল? আমার মনে হয়, যেন ওকে ছেড়ে চলেই যাই। ওকে তুমি না থামিয়ে আমার বকা থামাতে এসেছ কেন?" "আমি থামাইনি? দশ হাজারবার বলেছি। তোমার মেয়ে এমন কেন, তা তুমিই জান। তুমিই ওকে জন্ম দিয়েছ, আর তুমি ওর কথা বোঝ না?" মা বলল, "আমার মাথাটা গরম করে দিও না। কখন থেকে বলছি চলে যাও। তুমি না ওকে বেশি আদর কর। তাহলে ও যা  চায়, তা কিনে দাও না কেন?" তখন বাবা রাগ হয়ে নিজের মেয়ের উপর একটু মাথা গরম করল। মেয়েকে গিয়ে বলল, "এই মেয়ে! তুই এমন করিস কেন? আজ কিচ্ছু কিনে দিতে পারব না। শুধু তুই আমার স্কুলের কাজটুকু করে দিবি, ব্যাস। শোন, তাড়াতাড়ি ঘুমাও। কাল দুপুর, বিকাল, রাত কিছুতেই নয়; সকালে যেতে হবে আমাদের।" রূপাই তখন রাগ হয়ে গেল। রূপা বলল, "কেন শুনব আমি তোমার কথা? আমি এখন ঘুমাব না। রাতের বেলায় লাইট নিয়ে গিয়ে মাঠে খেলব। আমি তোমার কাজ করে দেব কেন? রাতের বেলা মাঠে খেলতে খুব মজা লাগে। আমি সকালে উঠবও না, রাত্রে তাড়াতাড়ি ঘুমাবও না, আমি তোমার অফিসের কাজও করে দেব না; তোমরা আমাকে কিছু দাও না, তোমরা আমার কথা না শুনলে আমি কেন তোমাদের কথা শুনব, তোমরা আস্তে আস্তে পচা হয়ে যাচ্ছ।" বাবা বলল, "এই মেয়ে! তোমার কথা শুনি না কে বলে? এই রূপো! এক সপ্তাহ ধরে কত জিনিস কিনেছি তোর জন্যে! তুমি কেন এমন কর? তুমি আমার একটা কথা শুনলে আমি তোমাকে ফুল আর প্রজাপতি ডিজাইনের জামা ও গোলাপী ডিজাইনের খাতা কিনে দেব। বাসায় কত খাতা আছে। সবুজ খাতা আছে, নীল খাতা আছে, সাদা খাতা আছে, কালো খাতা আছে, কফি কালারের খাতা আছে, আরো কত কী আছে!" তখন রূপা বলল, "আমার ঐ সব রঙের খাতা পছন্দ না। আমার লাল আর গোলাপী পছন্দ। আমার গোলাপী রঙের খাতা নাই।" বাবা বলল, "ঝগড়া করো না। তুমি আজ এই রুমেই শোবে। আমি অন্য রুমে শোব। এটাই তোমার শাস্তি। দেখি তুমি কি কর। আমি চলে যাই।" এই বলে বাবা তাড়াতাড়ি রুম থেকে বের হয়ে গেল। অন্য একটি রুমে ঢুকে দরজা লক করে দিল।" মা রুপার রুমে দরজায় উঁকি দিয়ে বলল, "রূপা! তোমার জন্যেই আমরা কিন্তু অন্য রুমে ঘুমাচ্ছি। তুমি কিন্তু আজকে এ রুমে শোবে, আমি বলে দিয়েছি। বাবা একটি ভালো শাস্তি দিয়েছে। প্রতিদিন ঘুমানোর সময় ঝগড়া কর। একদিন বল, পরীর গল্পের বই কিনে এনে পড়ে শোনাও। আরেকদিন বল, রাজকন্যার গল্পের বই কিনে এনে পড়ে শোনাও। একবার বল, রাজপুত্রের গল্প; আরেকবার বল, মিকি মাউসের গল্প; আরেকবার বল, টম এন্ড জেরির গল্প; আরেকবার বল, বারবি আর ফ্রোজেনের গল্প; আরেকবার বল, মরুভূমির রাজকন্যার গল্প শোনাও। আর কিন্তু এসব করা যাবে না। এসব করলে আমি কিন্তু আর কিচ্ছুই কিনে দেব না। আর এমন করলে আমি এই বাসায়ই ঘুমাব না, বাইরে গিয়ে ঘুমাব। দেখি, তুমি কি কর। রাতে পানি পিপাসা লাগলে তোমার নিজেরই উঠে পানি খেতে হবে। তোমার তো আবার রাতেই মাথা চুলকায়, রাতেই শ্যাম্পু করতে হয় আবার। দেখি, তুমি একা একা কিভাবে কাজ কর। অন্ধকারের মধ্যে বের হয়ে লাইট জ্বালাও কি করে।" "আমি আসি"- এই বলে মাও বের হয়ে গেল। ওদিকে বাবা বলল, "আমি শুনেছি, তুমি রূপোকে এমন এমন কথা কেন বলেছ? ও তো ছোট। আমি শুধু শাস্তি দিয়েছি যে, পানি খেতে চাইলে, মাথা চুলকালে আমি এসে সব ঠিক করে দেব, কিন্তু তারপর আবার আমি অন্য রুমে চলে যাব। কিন্তু তুমি আবার আগ বাড়িয়ে এত অতিরিক্ত শাস্তি দিতে যাচ্ছ কেন? ও এতসব করতে পারে? আমি ওর নানুর কাছে শুনেছি, তুমি নাকি ছোটবেলায় ওর মতই সারারাত শুধু গল্প শুনতে, মা-বাবাকে ঘুমাতে দিতে না?" তখন মা গেল রেগে। বলল, "আমার ছোটবেলা নিয়ে তোমাকে কে গবেষণা করতে বলেছে? আমি কিন্তু মাকে ফোন দিব।" "ফোন দেয়ার সুযোগ নেই! অনেক রাত হয়ে গেছে! তোমার মা-বাবা এখন ঘুমোচ্ছে। ঘুমের মধ্যে ডিস্টার্ব করলে তোমারই দোষ হবে। আমি গেলাম আমার রুমে!" মা রাগ হয়ে বলল, "Disgusting! অসহ্য! আমি আর থাকবই না এখানে। চলে যাব আমি।" বাবা বলল, "তোমাকে চেতিয়েছি! এবার আমি গেলাম আমার রুমে। বাচ্চাকে এতো শাস্তি দিয়ো না।" এই বলে বাবা চলে গেল রুমে। অনেক রাত হল। সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। বাবু মোবাইলে এর্লাম দিলো। ভোর চারটায় ঘুম থেকে উঠলো। বাবার পকেট থেকে গাড়ির জন্য টাকা নিলো। একটি গাড়িতে উঠে পড়ল। ব্যাংকে চলে গেল। হেটে যেতে বিশ মিনিট লাগত। গাড়িতে যেতে দশ মিনিট লাগত। দশ মিনিটে পৌঁছে গেল। একশত টাকা নিয়ে বাড়ি এল। বাবা দরজা লক করে রেখেছে। রূপা দরজায় টোকা দিল। বাবা দরজা খুলে দিলো। মা বলল, "দরজা খুলতে হবে না। খাকুক না বাইরে। ভাল করে একটু শিক্ষা দিতে হবে। দশ দিনে এক লক্ষ টাকা খরচ করেছে আমার।"কিন্তু বাবা দরজা খুলল। রূপা বলল,"বাবা দেখো তোমার জন্য একশত টাকা এনেছি ব্যাংক থেকে। বাবা বলল,"যাক বাবা যেতে হলো না ব্যাংকে।" রূপা বলল,"কিন্তু বাবা এই টাকা নিয়ে মার্কেটে যেতে হবে। খাতা আর জামা কিনে দাও।

No comments:

Post a Comment